বছর কয়েক আগে ‘নালন্দা’ পাঠশালা গড়ার আগে বরেণ্য সঙ্গীতজ্ঞ প্রয়াত ওয়াহিদুল হক আক্ষেপ করে আমাকে বলেছিলেন, “শিশু ছাত্রদের বিদ্যা দিগ্গজ করে তোলার উদ্দেশ্যে ওদের পিঠের ওপরকার স্কুল ব্যাগ এতই ভারী করে ফেলা হয়েছে, ওরা হাটে সামনে ঝুঁকে। দেখে মনে হয় ক্যাঙ্গারুর বাচ্চা! আদতে কিন্তু ওরা যা শেখে তার সবটাই মুখস্থ বুলি।” তারপর তিনি ও তার সতীর্থরা মিলে গড়ে তোলেন ‘নালন্দা’। ‘পূর্ণ মানুষ গড়ার’ অঙ্গীকার এই সমাজে যে কতো কঠিন! সেই কঠিন ব্রতকে সামনে নিয়ে এগিয়েছেন তাঁরা। অথচ এই ওয়াহিদুল হককে ১৯৭৬-৭৭সালে দেখেছি, যখন তিনি লালমাটিয়ার বাসিন্দা, স্কুলগামী শিশুপুত্রের ব্যাগ নিজের পিঠে বয়ে হেঁটে যাচ্ছেন।
শিশু শিক্ষা নিয়ে আক্ষেপ তো সেই রবীন্দ্রনাথেরও ছিল। যাকে ‘স্কুল’ নামক ভীতিকর অবস্থা থেকে পালাতে হয়েছে। লিখেছেন তিনিও, আমরা বাল্যকাল থেকে কৈশোর এবং কৈশোর থেকে যৌবনে প্রবেশ করি শুধু কিছু ‘কথার বোঝা’ টেনে টেনে। “সরস্বতীর সাম্রাজ্যে কেবলমাত্র মজুরি করিয়া মরি; পৃষ্ঠের মের“দন্ড বাঁকিয়া যায় এবং মনুষ্যত্বের বিকাশ হয় না।” সেই ট্রাডিশন আজও সমানে চলছে। কিন্তু তা ভাঙ্গার জন্য পথ ও পন্থা নানাভাবে দেখাও গেছে। তবে ঐটুকুই। সংবাদপত্রের পাতায় গত দুই দশক ধরে তো দেখা যায়, শিক্ষকের প্রহারে শিক্ষাথর্ীর জীবননাশ ও শিশুছাত্রী ধর্ষণ আর ইভটিজিং-এর দৌরাত্ম্য, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেক ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া ও পড়াশোনা বন্ধ। একসময় শুধু ছাত্র হয়ে থাকার ‘হীনতা’র প্রতিশোধ নিতে শিশু রবীন্দ্রনাথ বারান্দার এককোণে বসে, হাতে ‘কাঠি’ নিয়ে রেলিংগুলোকে পড়াতেন। ‘পড়াতেন’ মানে শুধুই পেটাতেন। এযুগের ছেলে মেয়েরা ওই ‘হীনতার’ শোধ তোলে এক ঘুষিতে সহপাঠীকে মেরে, হকি বা ক্রিকেট ব্যাটে পিটিয়ে সতীর্থকে খুন করে, শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যা করে। স্কুল শিক্ষা এখন কোচিং শিক্ষায় পরিণত হয়েছে। কোচিং ছাড়া বিদ্যা নাই-এর যুগ এখন। হা শিক্ষা! কেবলি বিনোয়োগ আজ। শিক্ষা আর অধিকার নয়।
বাঙালির শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ চিত্রটি জানা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান-এর। বাঙালির যথাযথ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য সেই ছাত্রজীবন থেকেই আন্দোলন; সংগ্রাম, জেল, জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে কাজ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হয়েছেন শাসকের রুদ্ররোষে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাও প্রবর্তন করেন। প্রণয়ন করেছিলেন শিক্ষানীতি। খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ডঃ মুহম্মদ কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের এই রিপোর্ট কার্যকর করার আগেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। স্বাধীন বাঙালি জাতির জন্য প্রযোজ্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভুলুন্ঠিত করে চালু করা হয় পশ্চাৎপদ শিক্ষা ধারণা ও ব্যবস্থা। পাকিস্তানী ও সাম্প্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধ এ শিক্ষা ব্যবস্থা জাতিকে অর্ধ শিক্ষিতের পথে ঠেলে দেয়। হরেক শিক্ষা কমিশন গঠন করে বাঙালি চেতনা বিরোধী শিক্ষার ক্ষেত্র প্রসার করা হয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি নিজেও সামরিক শাসনের ভেতর সেই পাকিস্তানী যুগে এক অভিনব শিক্ষা ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন। যুগোপযোগী শিক্ষার দাবীতে ছাত্র আন্দোলনে তাকেও শরীক হতে হয়েছে, দিতে হয়েছে নেতৃত্বও। শিশু শিক্ষার দুরাবস্থা তো তার জানাই। তবে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো ‘ভারবাহী’ শিক্ষার চাপ সইতে হয়নি যদিও। বিশ শতকের শেষে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সর্বাধিক মনোযোগী হয়েছিলেন। স্পষ্ট উপব্ধি করেছিলেন, এই যে পঁচাত্তর পরবতর্ী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তাতে মানুষের স্বাধীন বিকাশ হচ্ছে না। শিক্ষিত জাতি ছাড়া দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রমও নিয়েছিলেন। প্রতিটি জেলায় ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত সকল মানুষকে সাক্ষরতাদানের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। সাক্ষরতার হার ১৯৬৬ সালে যেখানে ছিল ৪৫ ভাগ, ২০০১ সালে ৬৬ ভাগে বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্বনির্ভর দেশ গড়তে এর বিকল্প নেই কিন্তু ক্ষমতায় না থাকায় সম্পূর্ণ নিরক্ষরতামুক্ত দেশ করা যায়নি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রণয়ন করেন শিক্ষানীতি। জাতির দীর্ঘদিনের চাহিদা পূরণ হয়েছে বৈকি। রবীন্দ্র পাঠক ও অনুরাগী শেখ হাসিনারও জানা, প্রচলিত শিক্ষা জ্ঞানের আস্থা জাগিয়ে তোলে, কিন্তু অন্তরের আলো জালিয়ে তোলে না। রবীন্দ্রনাথ যেমন দেখেছেন, “এ মানুষের সৃজনী শক্তির বিকাশে অভিসম্পাত দেয়। এর ফল বর্তমান যুগের বাঙালি জীবনের ক্রমবর্ধিত যত সব শোচনীয় এলোমেলো ভাবধারা।” শিক্ষার ভিত্তি শৈশবে যথাযথভাবে গড়ে তোলা না গেলে শিক্ষিত জাতি গড়ে উঠবে না। মন্যুষত্বের বিকাশ সাধন হবে না। শিক্ষার ভেতর যে গলদ, যে বৈষম্য, তা দূর করার উপায়গুলো কার্যকর করার একটা জায়গায় এসে থমকে যায়।
রবীন্দ্রনাথ গত শতকের সেই ত্রিশের দশকে যা উপলব্ধি করেছিলেন, আজ একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়ায় দঁাড়িয়ে শেখ হাসিনাও অনুভব করেন, সমাজের বিকৃত আদর্শের ধংসকর প্রভাব থেকে কোন শিক্ষাই শিশুকে রক্ষা করতে পারে না। উন্নত ও কল্যাণকর আদর্শ ব িত সমাজে শিশুর পক্ষে সুশিক্ষা লাভের সম্ভাবনা নেই। শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, “শিক্ষাথর্ীদের কাছে পাঠ্যপুস্তক সহজবোধ্য, আনন্দদায়ক ও জীবনমুখী করার লক্ষ্যে শিখন প্রক্রিয়ায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে শ্রেণীকক্ষে শিখন প্রক্রিয়াকে আরো সহজ এবং আনন্দদায়ক করাও সম্ভব হবে। তাছাড়াও এতে শেখার অনেকাংশ শ্রেণীকক্ষেই সম্পন্ন হবে”। পঁচাত্তর বছরেরও আগে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বলেছিলেন “শিক্ষাপদ্ধতি আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত হইতে পারে, কিন্তু শিক্ষার উদ্দেশ্য হীন অভিসন্ধিপূর্ণ হইলে শিক্ষাথর্ীর মন সমধিক কলুষিত হইয়া পড়িবে।” রবীন্দ্রনাথ তো সেই ভুক্তভোগী, যাকে বিদ্যালয় ছেড়ে আসতে হয়েছে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়ে ভীত হয়ে, যা শেষজীবন পর্যন্ত কাটেনি। বলেছেনও “শিশুকালে বিদ্যালয় গৃহের কঠোর আবেস্টনীর মধ্যে মানব প্রাণের সহানুভূতি ও প্রকৃতির শোভা হইতে ব িত জীবন আমার কি দুর্দর্শায় কাটিয়েছি, তাহা কখনও ভুলিতে পারিব না।” ভোলার কথাও নয়।
আমরা যারা ষাটের দশকে স্কুলগামী ছিলাম, তারা কি যথাযথ বা যুগোপযোগী শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে, তা তো নয়। পশ্চাৎপদ বাঙালি মুসলমানের জন্য পাকিস্তান যুগে শিক্ষার দ্বার খুব উন্মুক্ত ছিল না। পাঠ্যসূচি ছিল সমাজ, জীবনবিমুখ বিষয়ে পূর্ণ। একটি বিকাশমান জাতি-সম্প্রদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাদর্শও তৈরি হয়নি। ইংরেজ যুগে রবীন্দ্রনাথ যেখান থেকে শুর“ করেছেন, শতবর্ষ পেরিয়েও অবস্থা সেখান থেকে খুব বেশী উন্নত হয়েছে বলা যাবে না। রবীন্দ্রসাহিত্যের শিক্ষাথর্ী শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষেই বলেছেন, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রেণী কক্ষে শিখন প্রক্রিয়া আরও সহজ ও জীবনমুখী করা গেলে অভিভাবকদের আর প্রাইভেট টিউটরদের বাড়ী ছুটতে হবে না। ছেলেমেয়েরাও খানিকটা অবসর পাবে এবং নিজেদের বিকাশ ঘটাতে পারবে।” রবীন্দ্রনাথ তো এমন শিক্ষা ব্যবস্থাই বেছে নিয়েছিলেন। একদিকে পূর্ণ মানুষ তৈরি, অপরদিকে বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার জন্য উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছেনও তিনি। এটা তো বাস্তব, এযুগেও যে, শিক্ষার অভাব বাঙালি জাতিকে তার মেধা, মনন, চিন্তা, প্রতিভা, দর্শন, সংস্কৃতির বিকাশে অগ্রসর হবার সুযোগ দেয়নি। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যে জাতি একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে স্বাধীন জাতি হিসেবে পূর্ণ বিকশিত হতে পারেনি এখনো। জাতিকে সুশিক্ষিত করে তোলার জন্য বঙ্গবন্ধু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করে শিক্ষার টুঁটি চেপে ধরা হয়েছিল। ফলে পঁচাত্তর পরবতর্ী শিক্ষাক্ষেত্রে এক অরাজক অবস্থাই ছিল। শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী না হবার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোলযোগ স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত হয়। আজকের সময়ে শিক্ষাথর্ীদের যে অবক্ষয় চিত্র বেরিয়ে আসে, সে তো পঁচাত্তর পরবতর্ী অবস্থারই কুফল। শিক্ষার অভাবে দেশে এখনো কুসংস্কার আছে বলে মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ ফণা তোলে। কুসংস্কার ধর্মাচরণ থেকে জীবনাচরণকে কলুষিত করেছে। মানুষের প্রতি মানুষের অবিশ্বাস বেড়েছে। এখনো ভূত, প্রেত, ওঝা, তন্ত্রমন্ত্র মানুষকে প্রভাবিত করে, তার বিশ্বাসবোধেও ঠঁাই করে আছে। আধুনিক শিক্ষাও যে মানুষের মনকে সংস্কারমুক্ত করেছে বলা যাবে না। শিক্ষার উদ্দেশ্যই আজো স্পষ্ট নয় অনেকের কাছেই।
শিক্ষা যে কেবল বিদ্যাভাস বা পড়াশোনা তাতো নয়, তার উদ্দেশ্য মানুষের চেতনাকে মানবিক মর্যাদাপূর্ণ করে পারস্পরিক সম্প্রীতি, সদ্ভাব সৃষ্টি, জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে আনন্দে জীবনযাপন। শিক্ষার তিনটি অঙ্গ। প্রথমটি হচ্ছে সেই শিক্ষা, যার লক্ষ্য হলো ‘পূর্ণ মানুষ গড়া’। শিক্ষার দ্বিতীয় অঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন অর্থকরী বিষয়ে দক্ষতা প্রদান। আমাদের দেশে কারিগরি, প্রকৌশলী, চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান ভিত্তিক যে ধরনের শিক্ষা দেয়া হয়, সেই শিক্ষা। তৃতীয় অঙ্গ হচ্ছে, বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা, গবেষণা ও উচ্চতরমানের শিক্ষা প্রদান। শিক্ষার এই তিনটি অঙ্গের প্রথমটির কথা মাথায় রেখেই রবীন্দ্রনাথ তার ব্রহ্মাচর্যাশ্রম স্থাপন করেছিলেন। আর বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার তৃতীয় অঙ্গের কথা ভেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যাভবনের। যেখানে জ্ঞানচর্চা করে গেছেন সেই মুষ্টিমেয় স্বদেশী ও বিদেশী জ্ঞান সাধকেরা। শিক্ষার দ্বিতীয় অঙ্গ, যার প্রধান লক্ষ্য হলো বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনীয় প্রাথমিক প্রায়োগিক বিদ্যায় দক্ষতা প্রদান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়টি তার বিশ্বভারতীর জন্য একেবারেই ভাবেননি। এই তিনটি ভূমিকা ছাড়াও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থার চতুর্থ একটি অকথিত ভূমিকা আছে। কারো মতে, তা হলো বেকার সমস্যাকে ছদ্মবেশের অন্তরাল প্রদান করা। এতো বিশ্ববিদ্যলয় ও কয়েক হাজার মহাবিদ্যালয়ে যে শিক্ষা প্রদান করা হয়ে থাকে তার অধিকাংশ উপরোক্ত তিনটি ভূমিকার কোনটিই পালন করে না। ঐ শিক্ষা না করে পূর্ণ মানুষ গড়ার কাজ, না দেয় কোন অর্থকরী দক্ষতার প্রশিক্ষণ। বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার প্রসঙ্গ সম্ভবত এ ক্ষেত্রে কৌতূককর।
উচ্চমাধ্যমিক এর পর যে ছাত্র-ছাত্রী উচ্চতরশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তাদের অধিকাংশের উচ্চতর জ্ঞান আহরণের ক্ষমতাও থাকে না, আগ্রহও নয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে নিতান্তই গতানুগতিকভাবে। চাকরি নেই, অর্থকরী কোন ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। এই অবস্থায় ছেলেদের ক্ষেত্রে মনে করা হয়, কোনমতে যদি একটি ডিগ্রির সার্টিফিকেট যোগাড় করা যায়, তাহলে হয়তো বা চাকরি জুটবে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে মনে করা যে এমএ ডিগ্রিটা না হলে বিবাহযোগ্যতা অর্জন সম্পূর্ণ হয় না। সুতরাং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে যেসব শিক্ষাথর্ী, তাদের অধিকাংশ কালক্ষেপণ করে সম্পূর্ণ লক্ষ্যহীনভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে না ঢুকলে তারা বেকারদের সংখ্যা বাড়াবে, তাদের নিয়ে অনেক উপদ্রব হবে। অতএব উদ্দেশ্যহীনভাবে তাদের ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, অথবা বিজ্ঞান পড়াও। তারপর তাদের কেউ ঢোকে ব্যাংকে, কেউ হয় কেরানি, কেউ খুদে আমলা। মেয়েদের অধিকাংশই দর্শন এবং বিজ্ঞানে এম এ পড়ে তো বটেই, এমনকি মেডিক্যাল প্রকৌশলেও-পাস করেও শেষ পর্যন্ত হয়ে যায় নিতান্তই গৃহবধূ। এই ব্যবস্থাটা যে দেশের পক্ষে মঙ্গলকর নয়-সে নিয়ে বহু আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে।
আবারও মনে এলো, প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের কথা। শিক্ষা প্রসঙ্গেই বলেছিলেন গত শতকের শেষদিকে। তার মতে, এখনো অনেক আদর্শবাদী শিক্ষাথর্ী আছে, যারা শিক্ষার জন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে আগ্রহী। ভবিষ্যতে চাকরির জন্য নয়; এই রকম ছাত্র যদি নাই থাকবে, তবে কারা ভতি হয় ছবি আঁকা শিখতে, গান শেখার স্কুলে? এ কথা ভালোভাবেই জানে ছবি এঁকে বা গান গেয়ে আর্থিক ভবিষ্যৎকে সুনিশ্চিত করা যায় না। তবু তারা কমার্স না পড়ে ছবি আঁকা বা গান শেখতে আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই পুঁথিবিদ্যাধারী শিক্ষিত সমাজকে বিকশিত করতে চান জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আদর্শবাদিতা এবং সত্যনিষ্ঠতায়। অবাধ তথ্যের অধিকারকে তাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দেশকে ডিজিটাল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টারত তিনি। রবীন্দ্রনাথ তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, “পরীক্ষায় মার্কা দেখিয়ে চাকরি যোগাড় করা শিক্ষার একটি মূল উদ্দেশ্য হয়তো , কিস্তু কল্পনার বিস্তার বৃদ্ধির উন্মেষ ভিন্ন কোন শিক্ষাই শিক্ষা পদবাচ্য হয় না।” আর এই দুই আহরণের উপায় হিসেবে তিনি উলেখ করেছেন যে, “পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তথ্যানুসন্ধান চাই বুদ্ধির জন্যে, রসের উজ্জীবন চাই কল্পনার অবাধ বিচরণের জন্য”। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা পরিকল্পনায় তাই সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত ও কলাকৃষ্টির একটি সমন্বয়িত ছাঁচই স্বীকৃত। যা কোন দেশ কালের গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। বলেছেন কবি যে, “ভিত্তিটা ধরে রেখে সময়ের নির্দেশকে আমরা যদি মেনে না নেই তাহলে শূন্য ভিটায় আগাছা গজাবে। জীবন্তকালের স্পর্শ তাকে সযত্নে পরিহার করবে। “পরীক্ষা-পাশ ও ডিগ্রী অর্জনকে কাম্য মনে করেন নি কোন সময়ই রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু বাঙালি জীবনে পরীক্ষায় পাশ ও ডিগ্রী অর্জনের বিদ্যাই গুরত্ববহ। পাশ করা মানেই চাকরি, আর চাকরি মানে মাস শেষে মাহিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনাও তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমনটাই স্পষ্ট করেছেন যে, “কেবল পুঁথিগত বিদ্যায় মানুষের সম্যক স্ফূির্ত হতে পারে না। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়” -সে কথা উপলব্ধি করেই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন। যা বাস্তবায়নের পথে। এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাথর্ীদের কেবল কতকগুলো প্রাণহীন ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য শিক্ষা দেওয়া হয়ে এসেছে-তাই শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে সেখানেই ঠঁাই দিয়েছেন, যাতে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে। সম্প্রতি বলেছেনও তাই, “ একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী করে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং এর পাশাপাশি বিশেষ করে শিশু শিক্ষাথর্ীদের উপর যেন অযথা বাড়তি চাপ না পড়ে সেদিকে নজর রাখতে হবে।” রবীন্দ্রনাথ নিজেও প্রাথামিক শিক্ষার দরোজা থেকে ফিরে এসেছিলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার হাল-হকিকতের কারণে। তার শিশুমনও সেই শিক্ষায় সায় দেয়নি। লিখেছেন, “আমার জীবনে প্রথম বয়সে স্বল্প ক্ষণস্থায়ী ছাত্রদশা কেটেছে অভ্রভেদী শিক্ষা সৌধের অধস্তন তলায়। তারপর কিশোর বয়সে অভিভাবকদের নির্দেশমতো ততদিন সসংকোচে আমি প্রবেশ করেছিলুম বহিরঙ্গ ছাত্ররূপে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে। সেই এক দিন আর দ্বিতীয় দিনে পেঁৗছল না।”
‘ছোটো ও বড়ো’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ উলেখ করেছিলেন, “একটি ছেলে নিতান্ত একটি সহজ কবিতা আবৃত্তি করে পড়ছিল; আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘তুমি যে কবিতাটি পড়লে তার থেকে তুমি কি বুঝলে?’ সে বললে, ‘সে কথা তো আমাদের মাষ্টার মশায় বলে দেয় নি।’ ক্লাসে পড়া মুখস্থ করে তার একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, কবিতা থেকে নিজের মন দিয়ে বোঝবার কিছুই নেই। মাষ্টার-মশায় তাকে ব্যাকরণ অভিধান সমস্ত বুঝিয়েছে, কেবল এই কথাটি বোঝায় নি যে, রসকে নিজের হৃদয় দিয়েই বুঝতে হয়-মাষ্টারের বোঝা দিয়ে বুঝতে হয় না। সে মনে করেছে বুঝতে পারার মানে একটা কথার জায়গায় আর একটা কথা বসানো; ‘সুশীতল’ শব্দের জায়গায় ‘সুস্নিগ্ধ’ শব্দ প্রয়োগ করা । এ পর্যন্ত মাষ্টার তাকে ভরসা দেয়নি, তার মনের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অপহরণ” করেছে।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা মূলত বাল্য শিক্ষা নিয়ে। কারণ শিশুচিত্তই ব্যক্তিত্ববিকাশের প্রাথমিক ক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি সাহিত্য-সংগীত নিয়ে হলেও তার শিক্ষাদর্শ ও শিক্ষাভাবনা ছিল ব্যাপক। শিক্ষার জন্য জীবনের দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, শিক্ষার অর্থ মুক্তি। চিন্তার মুক্তি, কল্পনা প্রতিভার মুক্তি, সৃষ্টিশীল ভাবনার মুক্তি। বলেছেনও তিনি, “ সুশিক্ষার লক্ষণ এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তি দান করে।” এই মুক্তি সত্যের পক্ষে, মাত্রাজ্ঞানের পক্ষে, সৌন্দর্যের পক্ষে, সুর“চির পক্ষে, নীতি-নৈতিকতার পক্ষে, মূল্যবোধ ও চিন্তার আভিজাত্যের পক্ষে। রবীন্দ্রনাথের সহজাত উপলব্ধি ছিল- প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে এবং কাড়ি কাড়ি গ্রন্থ পাঠেই এই মুক্তি অর্জিত হয় না। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিন্তার দাসত্ব তৈরি হয়। এবং শিক্ষার নীচে চাপা পড়ে যাওয়া এ ধরণের শিক্ষিত মানুষ কারো জন্যই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ শিশু বা বালক শিক্ষার আদর্শগত বিষয়কে সর্বাধিক গুর“ত্ব দিয়েছেন। তার বিশেষ ভাববার বিষয় ছিল বালকদের চরিত্রগঠন-তাদের স্বাভাবিকভাবে স্ফূর্তি পেতে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ তাই চেয়েছিলেন শিক্ষার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তি, মনুষত্ববোধ ও সম্প্রীতির চচার্। উপলব্ধি ছিল, জাতি, ধর্ম, গোত্র, শ্রেণী, পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষের সঙ্গে যদি শান্তিপূর্ণ জীবনধারণের শক্তি না পাওয়া যায়, তবে শিক্ষার সার্থকতা প্রতিপন্ন হয় না। রবীন্দ্রনাথ তার সময়কালের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে ছিলেন কুন্ঠিত। ১৮৭৭ সালেই তিনি মূল্যায়ণ করেছেন, “বঙ্গদেশে এখন এমনি সৃষ্টিছাড়া শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত হইয়াছে যে তাহাতে শিক্ষিতেরা বিজ্ঞান দর্শনের কতকগুলি বুলি এবং ইতিহাসের সাল-ঘটনা ও রাজাদিগের নামাবলি মুখস্থ করিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু তাহাতে তাহাদের র“চিরও উন্নতি করিতে পারেন নাই এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা করিতেও শিখেন নাই।” মানবসভ্যতার বিকাশের পটভুমিতেই রবীন্দ্রনাথ তার শিক্ষাদর্শকে স্থাপন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে তার স্কুলকে গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন, তার বিবরণ পাই তার নিজের লেখাতে। তাছাড়া নানা স্মৃতিকথায়, জীবনী ও ইতিহাসে। বিভিন্ন উপলক্ষে নানা সময়ে স্বদেশে-বিদেশে বাংলা-ইংরেজিতে বক্তৃতায়-ভাষণে রবীন্দ্রনাথ তার পরিকল্পিত শিক্ষাদর্শের কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার নিজের বাল্যকালের শিক্ষালাভের অভিজ্ঞতার কথা ভোলেন নি। তাই তিনি পরীক্ষা ব্যবস্থাই নিমর্ূল করতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মুখস্থ করিয়া পাশ করাই তো চৌর্যবৃত্তি। যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাহাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই বা কম কী করিল?” রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে কেবল পাঠ্য কেতাবের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি। শিক্ষাকে দেখেছেন অনেক ব্যাপক দৃষ্টিতে। তার মতে, শিক্ষা জিনিসটা মূলত মানুষের আত্মীয়তা বিস্তারের চচার্। শিক্ষা মানুষের আত্মীয়তাবোধকে প্রসারিত করবে-আপন পরিবার-পরিজন থেকে প্রতিবেশী সমাজ, প্রতিবেশী মহল ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ অ লবাসীর মধ্যে, অ ল ছাড়িয়ে সমগ্র দেশ, দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে-সর্বমানবের মধ্যে ব্যাপ্ত হবে। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ শুধু মানুষের কথা ভেবেই ক্ষান্ত হন নি; প্রাণীজগত এবং উদ্ভিদজগতের কথাও ভোলেন নি। রবীন্দ্রনাথের মতে বিদ্যালয় শুধু বিদ্যাচর্চার স্থান নয়, গুণচচার্রও স্থান। শিক্ষাথর্ীর যার যেটা মনে ধরবে এমন কোন গুণের চচার্ করবে-গান করবে নয়তো ছবি আঁকবে, চামড়ার কাজ করবে, কেউ বা মাটির কাজ। শিক্ষা মানুষের মনকে সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে উদার মানবপ্রেমের পথে চালিত করবে, এই ছিল রবীন্দ্র শিক্ষাদর্শনের অন্যতম প্রধান কথা। তার শিক্ষাভাবনা বিশেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, তার শিক্ষাদর্শের সবচাইতে প্রধান কথা হচ্ছে; প্রাত্যহিক জীবনকে কি করে সহজ সুন্দর সরস করে তোলা যায় তার পথনির্দেশ।
শুধু বিদ্যাচচার্র দ্বারা যে সব শিক্ষার পূর্ণ উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। তেমনি আনন্দচর্চা এবং সৌন্দর্যর্চর্চা যত বড় জিনিসই হোক তাকে সবার্র্থ সাধিকা বলা চলে না। শিক্ষার চরম উদ্দেশ্য তখনই সিদ্ধ হবে, যখন শিক্ষা মানুষকে সত্যের সন্ধান দেবে এবং সত্যের পথে চালিত করবে। শিক্ষাথর্ীদের চরিত্র গঠনের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সবোর্চ্চ স্থান দিয়েছেন সত্যনিষ্ঠাকে। শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের প্রথম যুগে সকল অনুষ্ঠানে সঙ্গীত হিসাবে সম্মেলক কন্ঠে গাওয়া হত-‘মোরা সত্যের পরে মন আজি করিব সমর্পণ/ জয় জয় সত্যের জয়।’ ছাত্রদের যে সত্যব্রত দীক্ষা দিয়েছেন, কবি নিজে সে ব্রত পালন করেছেন আমৃত্যু আজীবন। বলেছেন, “যদি দুঃখে দহিতে হয় তবু অশুভ চিন্তা নয়। যদি দৈন্য বহিতে হয় তবু অশুভ কর্ম নয়। যদি দন্ড সহিতে হয় তবু অশুভ বাক্য নয়।’
বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর গত চারদশকেও কোন শিক্ষানীতিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়দফা ক্ষমতায় আসার পর যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছেন তা কার্যকর করা শুর“ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন “এই শিক্ষানীতির উলেখযোগ্য দিক হলো এখানে ধর্ম, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে মানুষের স্বভাবজাত অনুভূতিকে যেমন গুর“ত্ব দেয়া হয়েছে, তেমনি পার্থিবজগতে জীবন জীবিকার সুযোগ সৃষ্টিকারী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে- যা কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত করবে। দেশ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসম্পন্ন জ্ঞান লাভ করে বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।” শেখ হাসিনার শিক্ষানীতিতে জোরজবরদস্তি করে শিক্ষা দান নয়, শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তোলার পদক্ষেপ রাখা হয়েছে। শিশুদের জন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুর“ করার আগে শিশুর অন্তর্নিহিত আর অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতূহল, আনন্দবোধ ও অফুরন্ত উদ্যমের মতো সর্বজনীন মানবিক বৃত্তির সুষ্ঠু বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি গ্রহণের পরিবেশ তৈরি করার পদক্ষেপ রাখা হয়েছে। সেজন্য বিদ্যালয়ে-প্রস্তুতিমূলক-প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো রাখা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা, সৌহার্দ্যের স্বাধীনতা, বিশ্ব প্রকৃতির নিয়মসমূহ নিষ্ঠার সাথে পালন করে পার্থিব জগতের স্বাধীনতা এবং মানুষের সাথে মানুষের প্রীতি ও ভালোবাসার সম্বন্ধ অক্ষুণ্ন রেখে সামাজিক স্বাধীনতা অর্জন করা। শেখ হাসিনাও রবীন্দ্রনাথের মতোই বিদ্যা বিক্রয় বিরোধী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বিদ্যা বিক্রির দোকান ঘরে রূপান্তরিত হওয়ার ঘোর বিরোধী শেখ হাসিনা। কারণ তার কাছেও, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের পূর্ণতা। রবীন্দ্রনাথের মতো তারও উপলব্ধিতে ধরা আছে, শিশুদের মন, শিশুচিত্ত সবসময়ই অনিসন্ধিৎসু, তার জানার আগ্রহ তীব্র। শিশুদের চিত্তাকর্ষক বিষয়সমূহের প্রতি আকর্ষণ বেশি। শিশুদের প্রতি তার মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে প্রতিবছর ১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিবসকে ‘জাতীয় শিশু কিশোর দিবস’ হিসেবে পালনের মাধ্যমে।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনের কথা রবীন্দ্রনাথ বরাবর বলতেন। সবাই তা শুনতেন। কিন্তু ওইটুকুই! কবির নিজের কথায় “যখন দেখলাম আমার কথাগুলি শ্র“তিমধুর কবিত্ব হিসাবে সকলে নিলেন এবং যারা কথাটিকে মানলেন তারা একটাও কাজে খাটাবার উদ্যোগ নিলেন না; তখন আমার ভাবকে কাজের মধ্য দিয়ে আকার দান করার জন্য আমি নিজেই কৃতসংকল্প হলাম, আমার আকাঙ্খা হলো আমি ছেলেদের খুশি করব, প্রকৃতির গাছপালাই তাদের অন্যতম শিক্ষক হবে, জীবনের সহচর হবে-এমনি করে বিদ্যার একটি প্রাণ নিকেতন নীড় তৈরী করে তুলব।” এই সংকল্পের ফলশ্র“তি হল ‘সামান্য একটি বিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম।’ যার আদর্শ ছিল সরল জীবনযাত্রা বা ব্রহ্মচর্য। ওই নামই ছিল ২০ বছর, ১৯০১ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত। এর পর নাম হল বিশ্বভারতী পূর্ববিভাগ, ১৯২১ থেকে ১৯২৪ এবং ১৯২৫ থেকে বিশ্বভারতী পাঠভবন।
শেখ হাসিনা তার শিক্ষানীতিতে শিশুদের জন্য ‘অন্যান্য গ্রহণযোগ্য উপায়ের সঙ্গে ছবি, রং, নানা ধরনের সহজ আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ, মডেল, হাতের কাজের সঙ্গে ছড়া, গল্প, গান ও খেলার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা’ রেখেছেন। শিশুদের স্বাভাবিক অনুসন্ধিৎসা ও কৌতূহলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তাদের স্বাভাবিক প্রাণশক্তি ও উচ্ছ্বাসকে ব্যবহার করে আনন্দময় পরিবেশে মমতা ও ভালোবাসার সঙ্গে শিক্ষা প্রদান করার ব্যবস্থা রেখেছেন জননেত্রী। তবে বাস্তব অবস্থা হচ্ছে, এদেশে শিক্ষকতা কার্যে উপযুক্ত গুণসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিগ্রি থাকলেই যে শিক্ষক উপযুক্ত, তা মনে করা খুবই ভুল। শিক্ষায় ছাত্রদের আগ্রহ জন্মনোর, ছাত্রের সৃজনীশক্তি ফুটিয়ে তোলার গুণ থাকা শিক্ষকের পক্ষে একান্ত আবশ্যক। রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭ সালে বলেছিলেন, স্কুলে মাস্টারী ব্যবসায়ের মাল মজুত করিয়া লইয়াছি মনে করিয়া যে সকল শিক্ষক চিরদিনের জন্য সত্যের ক্রমবিকাশের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপে পরান্মুখ তাহারা শিক্ষাক্ষেত্রে কেবলমাত্র নিজ নিজ শিক্ষা অনুযায়ী বাসি-মালের সন্ধান দিয়া থাকেন। তাহারা বিদ্যাথর্ী-চিত্তকে ভারাক্রান্ত করিয়া তুলেন-জ্ঞান রসসি নে সমৃদ্ধ করিতে অক্ষম শিক্ষকদিগকে শিক্ষাথর্ীর আদর্শ সঙ্গী হইতে হইবে, শিক্ষা বিতরণকালে শিক্ষাথর্ীর তর“ণ মনের স্পন্দনের সহিত শিক্ষকের চিত্তেও সহানুভূতির আনন্দে পূর্ণ হইয়া ওঠে। শিক্ষাথর্ীদিগকে পরিচালিত করিবার দায়িত্ব যাহাদের উপর, তাঁহাদের হৃদয়ে যখন এই রূপ উৎসাহের অভাব ঘটে, যখন তাহারা শিক্ষাথর্ীর কাছে না যাইয়া তাহাকে সাহায্য করবার পরিবর্তে দূর হইতে বেত্র অবলম্বন করিয়া কর্তব্য পালনে উদগ্রীব হইয়া উঠেন; তখন তাহাদিগকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া কর্তব্য যে, তাহারা ভুল করিয়াছেন। মানবতার কল্যাণের দিকে চাহিয়া তাহাদের অবিলম্বে ছেলের পাহারাদারবৃত্তি অবলম্বন করা উচিত। কিন্তু বর্তমান যুগে এই শিক্ষকের সন্ধান দূরঅস্ত। শিক্ষা মানেই নোট বই। নোট বই মানেই ফটোকপি এবং মুখস্থ করা। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য বলেছেন, “শিক্ষক স্বয়ংকৃত না হইলে তিনি শিক্ষাদীক্ষা দিতে পারেন না। যে দীপশিখা স্বয়ং প্রজ্জলিত নহে’ তিনি শিক্ষকতা কার্যের অযোগ্য-তিনি শিক্ষাথর্ীর হৃদয়ে প্রেরণা জাগাইতে পারেন না।”
ইংরেজরা এদেশে রাজ্য স্থাপন করেছে পলাশীর যুদ্ধের পর। দীর্ঘকাল তারা এদেশে নতুন শিক্ষা প্রবর্তনের চেষ্টা করেনি। চেষ্টা হয়েছিল খ্রীষ্টান পাদ্রীদের দ্বারা। এদেশীয় ভাষা শিক্ষার জন্য ফোর্ট উইলিয়ামে শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। প্রাথমিক বই লেখা হলো। তাতে বিদেশীদের বাংলা শেখানো ছাড়া কোনও উদ্দেশ্য নেই। এই শিক্ষারীতি ছিল শাসকবর্গের শাসনকর্মের সুবিধার জন্য। ইংরেজ আসার আগে এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা তথা শিক্ষানীতি ছিল খুবই কর“ণ। তখন টোল চতুষ্পাঠীতে ব্রাহ্মণ সন্তানরা পড়তো। আর পড়ার বিষয় ছিল স্মৃতি, কাব্য, ন্যায়, বেদান্ত ইত্যাদি। আর মুসলমানরা পড়তো মক্তব্যে আরবী, ফাসর্ী। আর ব্যবহারিক শিক্ষা হতো পাঠশালায়। জমিজমার হিসাব, জিনিসপত্রের বিনিময় মূল্যের হিসাবপত্র শেখানোর জন্য ছিল পাঠশালা। কোনও কোনও মঙ্গলকাব্যে তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। উনিশ শতকের প্রথমদিকে পাঠশালায় প্রচলিত ‘প্রাইমারগুলোতে’ এই শিক্ষানীতির নিদর্শন রয়েছে। ইংরেজি শিক্ষা এদেশে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। শিক্ষার নতুন বিষয়, নতুন পদ্ধতি নিয়ে এলো। চালু হলো ইংল্যান্ডের শিক্ষা। শিল্প বিপবোত্তর শিক্ষানীতির প্রবর্তন। স্থাপিত হয় ইংরেজি স্কুল। এরপর হিন্দু কলেজে আধুনিক শিক্ষা। এসময় বিশ্বের আধুনিক শিক্ষাদর্শের সঙ্গে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রাণ খুঁজে পেলো। তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা চালু হলো। ভাষা শিক্ষা সেখানে শুর“ হয়। ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি মক্তব, পাঠশালা, টোল চতুষ্পাঠীও বহাল ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা চালুর ক্ষেত্রটি তৈরি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
শেখ হাসিনা আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, পথশিশু অন্যান্য ব িত শিশুদের শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার পদক্ষেপ নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ তাই চেয়েছিলেন, ‘অন্ধজনে দেহ আলো।’ শেখ হাসিনা বাঙালিকে বয়স নির্বিশেষে অক্ষরজ্ঞানের দিকে নিয়ে গেছেন। ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তিনিও চান শিশুদের তৈরি করতে পূর্ণ মনুষ্যত্বে। রবীন্দ্রনাথ তাই চেয়েছিলেন বলে সেই ১৯০১ সালেই বাল্যশিক্ষার জন্য শান্তিনিকেতন গড়ার প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। আর একুশ শতকে রবীন্দ্রানুরাগী শেখ হাসিনা বাল্যশিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছেন।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ ( পিআইবি)।