৪ ডিসেম্বর দেবীদ্বার হানাদার মুক্তদিবস উপলক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্নাঢ্য র্যালী, স্বাধীনতা স্তম্ভ ও বধ্যভূমি(গণকবর) এ পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
বুধবার সকাল ১০ টায় উপজেলা পরিষদ থেকে একটি বর্নাঢ্য র্যালী বের হয়ে পৌরসভার প্রধান সড়কগুলি প্রদক্ষিণ করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নিগার সুলতানা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রায়হানুল ইসালাম, দেবীদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরির্দশক মো. শাহিনুল ইসলাম, উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধ বিষয়ক গবেষক সাংবাদিক এবিএম আতিকুর রহমান বাশার, কুমিল্লা উত্তর জেলা মহিলা দলের সভাপতি সুফিয়া বেগম, উপজেলা বিএনপি নেতা মো. নজরুল ইসলাম সাবেক মুক্তি যোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সামাদ, উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ময়নাল হোসেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন কুমিল্লা জেলা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক কাজী নাছিরসহ প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। র্যালী শেষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সভাকক্ষে আলোচনা সভা ও দোয়া মিলাদের আয়োজন করা হয়।
আলোচকরা বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে দেবীদ্বার পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় দেবীদ্বার এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ৪ ডিসেম্বর। আলোচকগন আরো বলেন, নিজ নিজ এলাকার মুক্তিযুদ্ধের কথা আগামী প্রজন্মকে জানান দিতে হবে। তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেম জাগাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা তুলে ধরতে যেয়ে আলোচকরা বলেন, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে ওইদিন হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা করা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ‘কুমিল্লা-সিলেট’ আঞ্চলিক মহাসড়কের কোম্পানীগঞ্জ সেতুটি মাইন বিষ্ফোরনে উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্ড ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর.ডি হিরার নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। ওই দিন ভোর রাতে মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর বুড়িচং ব্রাক্ষনপাড়া হয়ে দেবীদ্বারে আসে। পাক হানাদাররা ওই রাতেই দেবীদ্বার ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ দেবীদ্বার সদরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবীদ্বার থেকে চান্দিনা রোডে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার সময় মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলি বিনীময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬সেনা সদস্য নিহত হয়। এই দিনে দেবীদ্বারের উল্লসিত জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে বিজয় উল্লাসে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে মেতে উঠে। দুপুর পর্যন্ত ওইদিন হাজার হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।
আলোচকরা বলেন, মুক্তি যুদ্ধে দেবীদ্বার বাসীর অবদান ছিল প্রশংসনীয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ, পালাটোনা ক্যাম্প প্রধান কিংবদন্তী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, সাবেক এমএনএ আব্দুল আজিজ খান, ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত ‘বিশেষ গেরিলাবাহিনী’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কমরেড আব্দুল হাফেজ, অন্যতম সংগঠক আজগর হোসেন মাষ্টার, ডাঃ আব্দুল আলীম, আছমত আলী সরকার, শহীদ নুরুল ইসলাম, শহীদ শাহজাহানসহ অসংখ্য কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধার অবদান ছিল স্মরনীয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান সেনা ছাউনি কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট দেবীদ্বারের খুব কাছে থাকার কারনে এ এলাকার মানুষ অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অপর দিকে ভারত সীমান্ত একই দুরত্বে থাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল চট্রগ্রামের মিরশরাই উপজেলার পরে অর্থাৎ দ্বিতীয় স্থানে। রাজাকারদের সহযোগীতায় এ অঞ্চলে নারকীয় হত্যাজজ্ঞ, লুন্ঠন, নারী নির্যাতন, অগ্নীসংযোগসহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে এ এলাকার মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রামে হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের তান্ডবের ছোঁয়া লাগেনি এমন গ্রাম দেবীদ্বারে নেই। পাক সেনাদের সাথে সম্মূখ সমর ও গণহত্যার তালিকাও কম নয়। ২৯ মার্চ যুদ্ধে ১৫ পাকসেনা নিহত ও ৩৩ বাঙ্গালী শহীদ। ২৪ এপ্রিল বরকামতা যুদ্ধে ৫ পাক সেনা ও ১৩ বাঙ্গালী শহীদ। ৬ সেপ্টেম্বর বারুর যুদ্ধে ৬ মুক্তি সেনা ও ২ নিরীহ বাঙ্গালী শহীদ। ১৭ সেপ্টেম্বর পোনরা যুদ্ধে নারায়নগঞ্জ নৌবন্দর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে নৌকমান্ডের ৮ সদস্যের সাথে পাকসেনাদের সাথে যুদ্ধে ২ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ। ১৬ অক্টোবর ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে দাড়িয়াপুর যুদ্ধে ৭ পাক সেনা নিহত। ১৬ সেপ্টেম্বর ভূষণা ও ধামতী গনহত্যায় ১১ নিরীহ বাঙ্গালী শহীদ। ১৭ সেপ্টেম্বর মহেশপুর গণহত্যায় ১৪ নিরীহ বাঙ্গালী শহীদ। ললিতাসার গনহত্যা ৭ নিরীহ বাঙ্গালী শহীদ। জাফরগঞ্জ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ২৪জুন মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গণহত্যায় ২৪০ নিরীহ বাঙ্গালীকে নির্মমভাবে হত্যা ও ১৯ জনকে দেবীদ্বার সদরে ব্রাসফায়ারে হত্যাপূর্বক মাটি চাপা দেয়ার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।