কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার গ্রামীণ ঐতিহ্যে দেশীয় গান-বাজনায় এখনো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে বাদ্যযন্ত্র ঢাক-ঢোল-তবলা। এছাড়া পহেলা বৈশাখ ও দুর্গাপূজায় ঢোলের যেন বিকল্প নেই। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র। বিশেষত অর্থনৈতিক সংকট ও ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমের প্রভাবে ঢোলের ব্যবহার হারিয়ে যাচ্ছে বলে জানান ঢোল কারিগররা। ঢাক-ঢোল, ঢুগি, তবলা, খোল, নাল, ঘটঘটি,খমো,মাদল,খনজনি,একতারা এবং দোতারাসহ আরো অনেক প্রকারের বাদ্যযন্ত্র আগের মতো বিক্রি হয় না। তাই হারমোনিয়াম-তবলা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সেই সুদিন প্রযুক্তির এই যুগে আর নেই। পারিবারিক পেশা টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেকেই। আবার অনেকেই পেশা বদলের সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। আগের মতো এখন আর ঢাক-ঢোলের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ঢাক-ঢোল তবলাসহ দেশীয় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র।
দেবীদ্বার উপজেলার রসুলপুর গ্রামের বাসিন্দা নিরাঞ্জন কর্মকার। দীর্ঘ ৩৫বছর ধরে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে আসছে ৫৫বছর বয়সের নিরাঞ্জন কর্মকার। ছোটবেলা থেকেই কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ বাজার জিয়া মার্কেটে তাদের পারিবারিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। মানিকগঞ্জ জেলার বাসিন্দা প্রদিপ দাস। ২০০০ সাল থেকে বর্তমানে কোম্পানীগঞ্জ বাজার-মুরাদনগর সড়কের বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক পশ্চিম পাশে বাদ্যযন্ত্রের নিউ বাদ্য ভান্ডার দোকান তার। উন্নত প্রযুক্তির যুগে এসে এসবের চাদিহা তেমন না থাকায় হতাশ বোধ করছেন তিনি।
তারা আরো বলেন, দু’বেলা-দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে এখানে পড়ে আছি। বর্তমানে ব্যবসার অবস্থা এতই খারাপ হয়েছে, বাসা আর দোকানভাড়া দিয়ে কোন রকমে পেটে-ভাতে টিকে আছি। কোন মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা পাই। আবার কোনো কোনো মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা দিয়ে চলতে ভীষণ কষ্ট হয়। সরকার যদি আমাদের দিকে তাকাতো, তাহলে আমরা এই ব্যবসা ধরে রাখতে পারতাম। বর্তমানে কাজকর্ম কমে গেলেও বাপ-দাদার আমলের এই ব্যবসা ছাড়তে পারছি না। কোনমতে আঁকড়ে ধরে টিকে আছি।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউপি’র সদস্য রামপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই নিরাঞ্জন কর্মকার ও প্রদিপ দাসকে দেখে আসছি তারা গিটার, তবলা, ঢোল এগুলো মেরামত করে আসছে। আগে এগুলো দেখতাম অনেক ভালো চলতো। কিন্তু বর্তমানে তার দোকানে আগের মতো ক্রেতা সমাগম দেখি না। মাসে স্বল্প আয় দিয়ে টেনেটুনে তাদের সংসার চলছে। ভবিষ্যতে এই পেশার কেমন বেহাল দশা হয় তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে সকল কারিগড়গন। দেশিয় লোকজ অনেক বাদ্যযন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে সরকারীভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে এমন নান্দনিক বাদ্যযন্ত্র গুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হয়তো চিনিয়ে বা পরিচয় করিয়ে দিতেই জাদুঘরের দ্বারস্থ হতে হবে।
বাউল শিল্প কাজী আমিনুল ইসলাম রেজাউল, লক্ষণ দাস, পাহাড়পুর গ্রামের অলিউল্লাহ সরকার বলেন, ১৫ বছর আগেও হারমোনিয়াম, তবলার বেচাবিক্রি বেশ ভালো ছিল। প্রতিদিনই কাজের অর্ডার(ফরমায়েশ) থাকতো। এখন আর নেই।
ব্যান্ড পার্টি মোঃ জালাল মিয়া ও কামালকান্দি গ্রামের নুরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কমে যাচ্ছে। এখন বাজার দখল নিয়েছে ইলেকট্টিক গিটার, কীবোর্ড, পিয়ানো, ড্রামসেট, ভায়োলিনের(বেহালা) মতো ভিনদেশি বাদ্যযন্ত্র। ডিজিটাল ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের ফলে এই শিল্পে আর সুদিন নেই। কাজকর্মও কমে গেছে।
মুরাদনগর নার্গিস- নজরুল শিল্পকলা একাডেমি পরিচালক নুরুল ইসলাম মাস্টার বলেন, গ্রামীন সংস্কৃতি বাঁচাতে হারমোনিয়াম-তবলা,ঢাক-ঢোল,খোল,বাঁ শির শিল্পের সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আমরা মন্ত্রনালয়ে আবেদন করে কোন সাড়া পাইনি।
মুরাদনগর বাঁধন সংগীত একাডেমি পরিচালক বাধঁন দেব বলেন, আমার একাডেমী ২৬বছর ধরে চলছে। আমার দাদী মা প্রায়তঃ মিনতি দেবের হারমোনিয়াম ব্যবহার করছি। গান মনের খোরাক। মানুষ মনের সুখে ও দুঃখে গান গায়। গান-বাজনা কমে গেছে। আগের মতো গানও নেই। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারও কম। কোনমতে টিকে আছি। দীর্ঘদিনের এই পেশায় সংসারও চলে কোনো রকমে।
বাঁশি ও তবলা প্রশিক্ষক ফেরদৌস আহমেদ বলেন, এখন কার নতুন প্রজন্ম এত কষ্ট করে গান-বাজনা শিখতে আগ্রহী নয়। সংগীতে হারমোনিয়াম-তবলা,
ঢোল-খোল,বাঁশির ব্যবহার হ্রাস পাচ্ছে। তুলনামূলক সহজ হওয়ায় বর্তমান প্রজন্ম ইলেকট্টিক বাদ্যযন্ত্রের দিকে বেশি ঝুঁকছে। দেশীয় সংস্কৃতি বাঁচাতে যথাযথভাবে এই শিল্পের সংরক্ষণের দাবি আমাদের মতো সাংস্কৃতিক কর্মীদের।
বাংলাদেশ জাতীয় বাউল সমিতি ফাউন্ডেশন কুমিল্লা জেলা শাখা সভাপতি এমরান সরকার বলেন, ৫২জন বাউল শিল্পি রয়েছে। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে পুরনো বাদ্যযন্ত্রগুলো। বর্তমানে যে কয়জন এ পেশায় জিবিকা নির্বাহ করছেন। তারাও আর বেশি দিন থাকবে না। রক্ষণাবেক্ষণ না হলে কয়েক বছর পর হয়তো দেখা যাবে এ পেশা বলতে কিছুই নেই।
মুরাদনগর শিল্পকলা একাডেমির সংগীত পরিচালক আনিছুর রহমান বলেন, আগে আমরা মঞ্চ নাটক করলে সেখানে ঢোল তবলার বাদ্য বাড়িয়ে নাটকের মোহরা করতাম। এখন আধুনিক ছোঁয়ার কারণে সেই যুগ পাল্টে গেছে। এখন আর মানুষ পরিশ্রম বা কষ্ট করতে চায় না। শিল্পীদের সঠিক মূল্যায়ন না করা হলে যন্ত্রপাতি তো হারিয়ে যাবে। দীর্ঘ ১৭ বছর মুরাদনগরে আছি। মাঝে মধ্যে মনে হয় সংগীত ছেড়ে দেই। উপজেলায় একটি শিল্প ভবন নেই। শিল্পীদের সংসার আছে, পেট আছে, তবুও শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন হয়না। শিল্পী সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।
মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ সিফাত উদ্দিন বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য হাতের তৈরী বাদ্যযন্ত্র শিল্পী গুষ্টির পেষা টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসন আর্থিক প্রণোদনা ও স্থানীয় বিসিকের মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হবে।