কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী রামচন্দ্রপুর বাজারে শত বছরের পুরোনো নৌকার হাটে কোষা নৌকা উৎসবের আমেজ ক্রেতা বিক্রেতার ধুম পড়েছে। এদেশের জনপদ রাস্তা-ঘাট ব্রিজ কালভার্ট তৈরী হওয়ায় ডিঙি, ডোঙা, সাম্পান, বজরা, গয়না, বাইচের, বাতনাই, বাচারি, ময়ূরপঙ্খী, বালার, পানসী, পাতম, একমালাই, মলার, ইলশা ও সওদাগরী নৌকা বড় বড় পন্যবাহী নৌকার বিলুপ্ত ঘটলেও শতবর্ষী রামচন্দ্রপুর হাটে কোষা নৌকার হাট এখনও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। চলছে বর্ষার মৌসুম। ভারী বর্ষণ। নদ-নদীতে থই থই পানি হওয়ায় এই হাটে নারায়নগঞ্জ জেলার আড়াই হাজার, নরসিংদী জেলার মাদবদী, ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা কসবা, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা কুমিল্লা জেলা হোমনা, তিতাস ও মুরাদনগর উপজেলার শত শত মানুষ নৌকা কিনতে ও বিক্রি করতে আসছে। মুরাদনগর উপজেলা ২২টি ইউনিয়নে ৩০৮টি গ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৭১টি নদ-নদীর মাঝে তিতাস নদী, গোমতী নদী, আরচি নদী, বুড়ি নদী,অদের খাল, নিমাইজুড়ি খাল, বিল, হাওড় বাওরে প্রতিটি জনপদে বাড়ছে পানি। কদর বেড়েছে ছোট ছোট নৌকার।
সরেজমিনে রামচন্দ্রপুর নৌকার হাট গিয়ে দেখা গেছে, মঙ্গলবার (৯ জুলাই) সাপ্তাহিক হাটে রামচন্দ্রপুর বাজার বসে টার্মিনাল ও কাচারি বাজারে এলাকাজুড়ে নানা ঢংয়ের ছোট ছোট নৌকা। পুরো এলাকা দৃষ্টিনন্দন করেছে সারিবদ্ধভাবে রাখা শত শত কোষা নৌকা। ক্রেতাদের ভিড়ে জমে ওঠেছে হাট। এখানে সাধ্যের মধ্যে সব শ্রেনি পেশার মানুষের জন্য পাওয়া যাচ্ছে নানা মাপের নৌকা। কাঠ মিস্তিরিরা এমনিতে নৌকা প্রস্তুত করে রাখে। ভাটি অঞ্চলের মানুষ রামচন্দ্রপুর বাজার ও ডুমুরিয়া বাজার হাট থেকে নৌকা কিনেন।
কৈজুরি গ্রামের নৌকার কারিগর রামপ্রসাদ সরকার ও বিক্রেতা বিমল সরকার বলেন, প্রতি সপ্তাহে কারিগররা ১০ থেকে ১২টি নৌকা তৈরি করে হাটে নিয়ে আসে। বর্তমানে কাঠ লোহা ও অন্যান্য সরংঞ্জামাদির দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। আমরা জামরুল, রেইনটি, আম, কদম ও শিমুল কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করি।
নৌকা কিনতে এসেছেন নবীনগর উপজেলা রতনপুর ইউনিয়নের বাজে বিশাড়া গ্রামের মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, আমার মাছের প্রজেক্ট আছে। আমাদের গ্রামটি ছোট। খুবই নিচু এলাকা। সামান্য বর্ষাতে রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ তলিয়ে যায়। বর্ষার সময় একমাত্র বাহন হচ্ছে নৌকা।
নৌকা ঘাটের ইজারাদার মুর্শিদ মিয়া বলেন, এখানে নাম মাত্র নৌকার টেক্স নেওয়া হয়। এসবের মধ্যে হাতে বাওয়া নৌকা যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। ছোট নৌকা ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা, মাঝারি নৌকা ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং বড় নৌকা ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
আমিননগর গ্রামের ইউপি’র সদস্য মোঃ আলমগীর হোসেন ও স্থায়ী বাসিন্দা মোঃ ইব্রাহীম খলিল বলেন, বছরে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত এই অঞ্চলের কোষা নৌকার সবচেয়ে বড় হাট বসে। এই সময়ে সচরাচর বর্ষা দেখা দেয়। রামচন্দ্রপুর নৌকার হাটে এসময় ভিড় লেগেই থাকে। নৌকা তৈরীর কারিগররা দিন রাত ধরে নৌকা তৈরী করছেন। এখন তাদের ব্যস্ত সময়, আয়ের সময়।
রামচন্দ্রপুর বাজার বনিক সমিতির সভাপতি মোঃ জীবন মিয়া মেম্বার বলেন, রামচন্দ্রপুর বাজারের নৌকা বিক্রির প্রচলন শত বছরের অধিককাল আগে থেকেই প্রতি মঙ্গলবার হাট বসে। বিভিন্ন জেলা থেকে নৌকা ক্রেতারা তাদের সাধ্যের মধ্যে নৌকা ক্রয় বিক্রয় করে থাকেন।
রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ ইকবাল হোসেন সরকার বলেন, রামচন্দ্রপুর বাজারের আশেপাশের উপজেলা সবকটি ইউনিয়নে বর্ষা আসলেই নৌকা কিনতে আসে। প্রতি মঙ্গলবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা বেচাকেনা হয়। এঅঞ্চলের চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের নৌকা পাওয়া যায়।
মুরাদনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ড. আহসানুল আলম সরকার কিশোর বলেন, তিতাস নদীর পাড়ে রামচন্দ্রপুর বাজারটি আমার ইউনিয়নে পড়েছে। রামচন্দ্রপুর বাজার নৌকা হাটটি কুমিল্লা জেলা ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে মিশে আছে। মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা জল ও স্থল পথে রয়েছে। ঐতিহাসিক রামচন্দ্রপুর বাজার সাপ্তাহিক হাটের সুনাম রয়েছে। নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, বাবুর হাট, ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা জুড়ে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাটে নৌকা কিনতে আসে বিভিন্ন শ্রেনি পেশার মানুষ। রামচন্দ্রপুর বাজারে নৌকার ঘাটেই এখন ক্রেতার ভিড় থাকে।