বিশ্বব্যাপী স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রচারে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা নৈতিক নির্দেশিকা এবং আচরণবিধির একটি সেট মেনে নির্বাচনের অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন এর মতে, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষক আবেদন করেননি। ১৭ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ের সময় এ তথ্য প্রদান করা হয়। যদিও কোনো বিদেশী পর্যবেক্ষক নির্বাচন তদারকি করার জন্য অনুরোধ করেননি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি নির্বাচন প্রাক-মূল্যায়ন প্রতিনিধি দল ৯ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ সফর করেছে। উপরন্তু, অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। সাবরিন জোর দিয়ে বলেন যে কোন বিদেশী পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি দেওয়া হলে তাদের বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন এবং নির্বাচন কমিশন কর্তৃক বর্ণিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতি কে মেনে চলতে হবে।
এ নিবন্ধটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ঐতিহাসিক বিবর্তন, গণতন্ত্রের উপর এর প্রভাব, এবং এর প্রয়োজনীয় আচরণবিধি যা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের তাদের দায়িত্ব পালনে দিক নির্দেশনা দেয় তা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস। নির্বাচন পর্যবেক্ষণের চর্চা ১৯ শতকের শুরু হয়েছিল যখন বিভিন্ন দেশের সরকারগুলিকে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আধুনিক ধারণা ২০ শতকের শেষার্ধে আকর্ষণ ও গতি লাভ করে। জাতিসংঘ নির্বাচনের তদারকি করার জন্য বিভিন্ন দেশে পর্যবেক্ষক মোতায়েন করা শুরু করে, বিশেষ করে দ্বন্দ্ব-পরবর্তী গণতন্ত্রের উত্তরণে।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে গণতন্ত্রীকরণের তরঙ্গের সময় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আরও বেশি তাৎপর্য গ্রহণ করেছিল। অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ (ওএসসিই), ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক সংস্থাগুলি নির্বাচন পরিচালনার মূল্যায়ন এবং উন্নতির জন্য সুপারিশ প্রদানের জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক মিশন পাঠাতে শুরু করে। গণতন্ত্রের উপর আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রভাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। এ পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের বৈধতা বাড়াতে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। নির্বাচনের বিভিন্ন পর্যায় পর্যবেক্ষণ করে, প্রচারণা কার্যক্রম থেকে শুরু করে ভোট গণনা পর্যন্ত, পর্যবেক্ষকরা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে যে নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুভাবে এবং কোনো প্রকার কারচুপি ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে । আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি নির্বাচনী জালিয়াতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এ পর্যবেক্ষকদের দ্বারা প্রদত্ত যাচাই-বাছাই প্রায়ই সরকার এবং নির্বাচনী সংস্থাগুলিকে গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে বাধ্য করে। পর্যবেক্ষক মিশন দ্বারা প্রস্তাবিত সুপারিশগুলি নির্বাচনী সংস্কার এবং পরবর্তী নির্বাচনে উন্নতির জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ হিসাবে ও কাজ করে।
আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা একটি কঠোর আচরণবিধি বজায় রেখে গণতন্ত্রের প্রচারে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। তাদের নিরপেক্ষ মনিটরিং এবং রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে, তারা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়েছে । নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ঐতিহাসিক অগ্রগতি বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে এর ক্রমবর্ধমান তাৎপর্যের ওপর জোর দেয়। যেহেতু এই পর্যবেক্ষকরা গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অগ্রগতিতে অবদান রেখে চলেছেন, তার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতা রক্ষায় নৈতিক নির্দেশিকাগুলি প্রতি তাদের আনুগত্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের জন্য আচরণবিধি : তাদের কাজের কার্যকারিতা এবং সততা নিশ্চিত করার জন্য, আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা একটি আচরণবিধি মেনে চলে। এই কোড নীতি এবং আচরণের রূপরেখা দেয় যা পর্যবেক্ষকদের তাদের মিশনের সময় অনুসরণ করা উচিত। আচরণবিধির কিছু মূল উপাদানের মধ্যে রয়েছে:
নিরপেক্ষতা: পর্যবেক্ষকদের অবশ্যই নিরপেক্ষ এবং নিরপেক্ষ থাকতে হবে, কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর পক্ষে হতে পারে এমন কোনো কাজ বা বিবৃতি থেকে বিরত থাকতে হবে।
পেশাদারিত্ব: পর্যবেক্ষকদের উচিত আয়োজক দেশের আইন ও বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে পেশাদার পদ্ধতিতে তাদের দায়িত্ব পালন করা।
সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা: পর্যবেক্ষকদের অবশ্যই আয়োজক দেশের সার্বভৌমত্ব এবং তার নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্মান করতে হবে যখন উন্নতির জন্য গঠনমূলক সুপারিশ প্রদান করবেন।
স্বচ্ছতা: পর্যবেক্ষকদের স্বচ্ছভাবে কাজ করা উচিত, তাদের কার্যক্রম এবং ফলাফল গুলি সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা উচিত।
অ-হস্তক্ষেপ: পর্যবেক্ষকদের অবশ্যই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ এড়াতে হবে এবং আয়োজক দেশের নির্বাচন পরিচালনা সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দৃঢ়ভাবে কঠোর আচরণবিধি মেনে চলার মাধ্যমে, এই পর্যবেক্ষকদের গণতন্ত্রের প্রচারে একটি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। নিরপেক্ষ মনিটরিং এবং সঠিক প্রতিবেদনের প্রতি তাদের অঙ্গীকার নিশ্চিত করে যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছতার সাথে পরিচালিত হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রদান করে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা স্থানীয় জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উভয়ের মধ্যেই আস্থা সৃষ্টি করতে পারে, নির্বাচনের অখণ্ডতা ও বৈধতা রক্ষায় অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশ যখন এই গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরু করে, তখন এই পর্যবেক্ষকদের পরিশ্রমী কাজ একটি আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে, যা জাতিকে একটি উজ্জ্বল গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করে।
লেখক:দেলোয়ার জাহিদ একজন মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি সদস্য, সভাপতি, বাংলাদেশ উত্তর আমেরিকান জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক, আহ্ববায়ক, বাংলাদেশ নর্থ-আমেরিকান নির্বাচন পর্যবেক্ষণ হাব ও কানাডার বাসিন্দা।