কুমিল্লার হোমনায় মাদ্রাসার মুহতামিমের বিরুদ্ধে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে হেফজ বিভাগের এক শিক্ষার্থীর দুই নিতম্ব এবং পায়ের তলা পুড়িয়ে নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। নির্যাতনে সহযোগিতার অপরাধে মাদ্রাসার এক শিক্ষককে গ্রেফতার করছে পুলিশ। মুহতামিম হাফেজ মো. সাইফুল ইসলাম হাবিব, গ্রেফতার শিক্ষক মো. আতিকুল ইসলামসহ আরও তিন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় ২৭ পারা হেফজ করা আবদুল কাইয়ুমকে গরম ইস্ত্রি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে ছ্যাঁকা দিয়ে শাস্তি দেয়। এতে তার দুই নিতম্ব এবং পায়ের তলা ঝলসে যায়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে উপজেলার নয়াকান্দি মমতাজিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় এ রোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। হেফজ বিভাগের নির্যাতিত শিশু আব্দুল কাইয়ুমের (১৮) মা সোমবার বিকেলে ছেলের জন্য খাবার নিয়ে মাদ্রাসায় গেলে ঘটনা প্রকাশ পায়।
খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা, হোমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জয়নাল আবেদীন ওই মাদ্রাসা পরিদর্শন করে ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে শিশুটিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এ ঘটনায় সোমবার রাতে মা হাফেজা বেগম মূল অভিযুক্ত মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ মো. সাইফুল ইসলাম হাবিব, সহযোগী শিক্ষক আতিকুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে হোমনা থানায় মামলা করেন। মূল অভিযুক্ত মুহতামিম ও আসামী তিন শিক্ষাথী পালিয়ে গেছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবদুছ ছালাম সিকদার বলেন, দেখে মনে হয়েছে, দশ-বারো দিন আগেই পুড়েছে। পোড়া দুই নিতম্বেই গভীর ঘাঁ হয়ে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গতকাল মঙ্গলবার তাকে ঢাকা শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়েছে।
সূত্রে জানা যায়, ওই মাদ্রাসাটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠালাভ করে। কোনো নিবন্ধন ছাড়াই ১৩ বছর ধরে এ মাদ্রাসায় রিভিশন বিভাগ, হেফজ বিভাগ, নাজেরা বিভাগ ও নূরানী বিভাগসহ চারটি বিভাগে ছাত্রদের শিক্ষাদান চলছে। হেফজ বিভাগের ছাত্র আব্দুল কাইয়ুম উপজেলার চান্দেরচর গ্রামের বাহরাইন প্রবাসী আ. কাদির ও হাফেজা বেগমের সন্তান। এ ঘটনায় মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির এক বিশেষ সভায় গতকাল মঙ্গলবার মুহতামিমকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করেছে।
স্থানীয় এবং শিশুটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সহপাঠীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করার সময় পরনের লুঙ্গি খুলে যায় আবদুল কাইয়ুরেম। এ কথাটিই তারা মুহতামিমকে জানালে তিনি রাতের বেলা গ্রেফতার শিক্ষক আতিকুল ইসলামসহ আরও তিন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় শিশু আবদুল কাইয়ুমকে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেন। গত দশ দিন শিশু আবদুল কাইয়ুমকে একটি বদ্ধ রুমে একাকী আটকে রেখে মুহতামিম সাইফুল ইসলাম চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে রাখার কারণে কেউ এতদিন মুখ খুলেনি। এখনও ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। গভীর পোড়া ক্ষতের কারণে ঠিকমতো সে চলাফেরাও করতে পারছিল না। সোমবার বিকেলে কাইয়ুমের মা হাফেজা বেগম ছেলের জন্য খাবার নিয়ে মাদ্রাসায় গেলে প্রথমে তাকে সাক্ষাত করতে দেয়নি। পরে অনেক চেষ্টার পরে তাকে দেখতে দেওয়া হয়। অভিযুক্ত মুহতামিম হাফেজ মো. সাইফুল ইসলাম (২৮) উপজেলার নয়াকন্দি গ্রামের রেনু মিয়ার ছেলে এবং গ্রেফতার শিক্ষক আতিকুল ইসলাম (২৮) মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার শ্রীকাইল গ্রামের শহিদ মিয়ার ছেলে।
নির্যাতিত শিশু আবদুল কাইয়ুম জানান, ওই দিন সে তার অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাচ্ছলে দুষ্টুমি করছিলেন। এক ফাঁকে তার পরনের লুঙ্গি খুলে যায়। এ ঘটনাটিই তারা তাদের মুহতামিমকে জানায়। এর শাস্তি হিসেবে ওই (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে মুতামিম অফিসে নিয়ে শিক্ষক আতিকুল এবং তিন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় তার নিতম্ব এবং পায়ের তলায় গরম ইস্ত্রি লাগিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দেয়। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও সবাই ঘুমিয়ে থাকায় কেউ শুনতে পায়নি। পরে তার এমন শাস্তির বিষয়টি কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়।
মা হাফেজা বেগম বলেন, সোমবার সকালে আমার ছেলের জন্য খাবার নিয়া মাদ্রাসায় গেলে সে আমাকে দেখে কাঁদতে থাকে এবং বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়। ছেলের মানসিক অবস্থা বুঝে তাক বাড়ি নিয়া যাই। বাড়িতে গিয়ে আমাকে সে তাহার জখমের জায়গা দেখিয়ে পুরো ঘটনা বলে। ছেলে ইস্ত্রির ছঁ্যাকায় গুরুতর জখম হওয়ায় তাকে তাৎক্ষণিক হোমনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। তারা আমার ছেলের প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করেছে। বিষয়টি আমার প্রবাসী স্বামী এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানিয়ে হোমনা থানায় অভিযোগ করি।
ইউএনও ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন, সোমবার বিকেলেই খবর পাই যে, নয়াকান্দি মমতাজিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার ‘বড় হুজুর’ এক শিক্ষার্থীর পেছনে (নিতম্বে) ইস্ত্রি গরম করে ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দিয়েছে। সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। শিশুটিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। ইস্ত্রি এবং মাদ্রাসার সিসি টিভির হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলো থানায় জমা আছে। পাশাপাশি এলাকাবাসীকে বলেছি, এ ঘটনায় তারা আতঙ্কিত কিনা। তাদের কাছে জেনে মাদ্রাসা কমিটিকেও বলেছি বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে। প্রয়োজনে বরখাস্ত করা যেতে পারে। রাতে থানায় মামলা হয়েছে। আমরা নজর রাখছি।
হোমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, শিশু আবদুল কাইয়ুমকে ওই মাদ্রাসার শিক্ষক কতর্ৃক গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে পোড়ার ঘটনায় মুহতামিম হাফেজ সাইফুল ইসলাম, শিক্ষক আতিকুল ইসলামহ আরও তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে রাতে মা হাফেজা বেগম বাদি হয়ে মামলা করেছেন। আতিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।