“দশ বছর আগে আমার স্বামী জামাল হোসেন মারা যান। তার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরে একটি মুদি দোকান ছিল। মৃত্যুর আগে তিনি ব্রাহ্মণপাড়ার আরেক পরিচিত ব্যবসায়ী কাওছারকে ৮ লাখ টাকা ব্যবসা করার জন্য ধার দেন। কিন্তু আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর কাওছার আর সে টাকা দিচ্ছি দিব করে ফেরৎ দেন না। এদিকে জীবদ্দশায় আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করেন। তাই বিষয়টি আরো জটিল আকার ধারণ করে। ফলে এসএসসি পরিক্ষার্থী এক মেয়ে এবং স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলেকে নিয়ে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে দিন পার করছিলাম। এমন পরিস্থিতিতে নান জনের নিকট ধর্না দিয়েও যখন কোনো প্রতিকার পাচ্ছিলাম না তখন ব্রাহ্মণপাড়ার ইউএনও সোহেল রানা স্যারের নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দিই। স্যার আমার সমস্যা শুনে অল্প সময়ের মধ্যে পাওনা টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত পথে বসার হাত থেকে রক্ষা করেন। বর্তমানে আমার এসএসসি পরীক্ষার্থী মেয়ে এবং স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলেকে পড়াশোনা করাতে পারছি এবং আমার বৃদ্ধা মাকে সাথে নিয়ে বেশ সুখে বসবাস করছি। স্যার যদি আমার এ জটিল সমস্যার সমাধান না করতেন, তাহলে আমার যে কী হতো তা ভাবতেই শিউরে উঠি।
কথাগুলো বলছিলেন, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার পুর্বহুড়া ক্যান্টনমেন্ট এলাকার কুহিনূর বেগম। শুধু কূহিনুর বেগম একা নন, এরকম নানা পারিবারিক ও সামাজিক জটিল সব সমস্যা নিয়ে সকাল থেকে রাত অবধি সমাজের নানা স্তরের মানূষ ভিড় করে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানার অফিসে। ইউএনও সোহেল রানা এসব সমস্যার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং প্রতিটি ঘটনা আলাদা আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুষ্ঠু সমাধান করেন। ফলে কাক্সিক্ষত সেবা পেয়ে সমাজের অসহায় মানুষগুলো যেন আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন।
বৃহত্তর কুমিল্লার গ্রাম-গঞ্জের মানুষজনকে প্রায়ই গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এসব দ্বন্দ্বের কারণে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, পাল্টাপাল্টি মামলা হয়। সর্বোপরি, সর্বদা একটি অশান্তির পরিবেশ বিরাজ করে। এসব দ্বন্দ্ব আপোষ মীমাংসার মাধ্যমে সমাধান করতে দেখা যায় জনপ্রিতিনিধিদের। তবে, ব্রাহ্মণপাড়ায় শান্তির দূত হিসেবে এ ভূমিকা নিরলসভাবে পালন করেছেন ইউএনও সোহেল রানা। ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সাল থেকে উপজেলায় যোগদানের পর থেকে গত দুই বছরে শিদলাই, ধান্যদৌল, বলাখাল, বালিনা জিরাত, নাগাইশ এর একাধিক গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব নিয়ে কাজ করেছেন ইউএনও সোহেল রানা। এর মধ্যে শিদলাই, ধান্যদৌল ও বলাখাল এর গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের নিরসন হয়েছে। নাগাইশ ও বালিনা জিরাতের দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগ নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি শান্ত আছে বলে মনে করেন অনেকে। এসব সমাধানে সঠিক সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে খুন খারাবি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিলো। নিজ দায়িত্বের পরিধির বাইরে গিয়ে একের পর এক বৈঠক, আলোচনা ও শুনানির মাধ্যমে এসব দ্বন্দ্বের সফল পরিসমাপ্তি ঘটান ইউএনও। মূলত ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়, দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার, ও ভবিষ্যতে শান্তির জন্য মেকানিজম তৈরী করা হয় এসব বৈঠকে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে দায়ের হওয়া এ ধরনের অভিযোগের সংখ্যা ২৭৫টি। যার মধ্যে ১২৯টি অভিযোগই সুষ্ঠুভাবে নিস্পত্তি হয়েছে। অভিযোগ নিস্পত্তির হার শতকরা ৪৫ শতাংশেরও বেশি। কিছু সমস্যা নিষ্পত্তির পথে। যা একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের জন্য এক বিরল ঘটনা। আদালতের বাইরে অল্প সময়ে একটি উপজেলায় এতগুলো অভিযোগ নিস্পত্তির ঘটনা ঈর্ষণীয়।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষানুরাগী মোশাররফ হোসেন খান চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তিনি জানান তার নিজ গ্রাম ধান্যদৌলে সংঘটিত একটি কবরস্থানকে ঘিরে সামাজিক দ্বন্দ্ব সংঘাত নিরসনে ইউএনও সোহেল রানার আবদানের কথা। তিনি বলেন, “বহুদিন ধরে ধান্যদৌল গ্রামের মানুষ একে অপরের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পূর্বে একটি কবরস্থানের মাটি ভরাট ও রাস্তা নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব গড়ায় সহিংসতায়। উভয় পক্ষে মামলা হামলায় এক সহিংস পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মামলার কারণে কেউ রাতে বাড়িতে ঘুমোতে পারতো না। ব্যক্তি হিসেবে সামাজিকভাবে যত অর্জন সব যেন ম্লান মনে হয়। এমন অবস্থায় আশার আলোকবার্তিকা হয়ে পাশে দাঁড়ান ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা। তিনি তার সম্মোহনী ক্ষমতার মাধ্যমে এবং বিচক্ষণতা দিয়ে উভয় পক্ষের সঙ্গে বসে একটি সুষ্ঠু সমাধান করে দেন। ফলে নিশ্চিত একটি স্থায়ী সংঘাতের হাত থেকে আমার গ্রাম ধান্যদৌলকে তিনি রক্ষা করেন। তাঁর এ ঋণ আজীবন ভুলবার নয়”।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বলাখাল-চারাধারী গ্রামের দুই পক্ষের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘাত দুই গ্রামের মানূষকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ঘটে দফায় দফায় হামলা ও মামলার ঘটনা। উপজেলার আলোচিত শিদলাই গ্রামের শতবর্ষী দ্বন্দ্বের মতো আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের দিকে যখন ঘটনাটি এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন ব্রাহ্মণপাড়ার ইউএনও সোহেল রানা।
এ প্রসঙ্গে বলাখাল গ্রামের বিশিষ্ট তরুন সমাজসেবক সালেহ আহমেদ সেন্টু বলেন, “একটু ভুল বোঝাবুঝি থেকে সৃষ্ট চারাধারী ও বলাখাল এই দুই গ্রামের মানুষ একে অপরের চরম শত্রুতে পরিনত হয়। ঘটে সহিংসতা ও মারামারির ঘটনা। স্থানীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সর্দার-মাতবররা অনেক চেষ্টার পরেও যখন কোনো সমাধানে আসতে ব্যর্থ হন, তখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের উদ্যোগে এখন আমরা দুই গ্রামের মানুষ একসাথে মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বসবাস করছি। এজন্য আমরা বলাখালবাসী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহোদয়ের নিকট বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ”।
অপরদিকে চারাধারী গ্রামের নারী নেত্রী শিরিন সুলতানা বলেন, “চারাধারী-বলাখাল এই দুই গ্রামবাসীর মধ্যে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব ইউএনও স্যার যদি সমাধান না করতেন তাহলে আমরা অনেকদিন পিছিয়ে যেতাম। এজন্য চারাধারীর মানুষ ইউএনও সোহেল রানার অবদান বহুদিন স্মরণে রাখবে”।