ছেলেদের আসার অপেক্ষায় রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মহাসড়কের পাশে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত বৃদ্ধ। মহাসড়কের উপর দিন রাত হাজারও গাড়ি যাতায়াত করছে। অনেক গাড়ি স্টেশনে থামার পর যাত্রী নামছে। যাত্রীসহ সব পথচারীদের মুখের দিকে ফেল ফেল করে তাকিয়ে দুই চোখের পানি ঝড়াচ্ছেন। চোখের পানি শুকিয়ে গেলেও আসছে না তার সন্তানরা। তারপরও আশা ছাড়েননি এই রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ চান মিয়া। কেউ জানতে চাইলে বলেন, আমার ছেলেরা এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমাকে এখানে বসে থাকতে বলেছে, তারা আসবে।
গত ৬ অক্টোবর ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বড়গোবিন্দপুর স্টেশন এলাকায় বসে আছেন সাদা চুল দাঁড়ির এই বৃদ্ধ। পাশে এক ভাঙ্গা হুইল চেয়ার। বেশ কয়েকদিন অযত্ন অবহেলায় পাগল বেশে রূপ নিয়েছে তাঁর। প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বাম হাত ও পা তেমন নড়াচড়া করতে না পেরে একই স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন এই বৃদ্ধ। দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেলেও খোঁজ নিতে আসেননি তার সন্তানরা। স্থানীয়দের মধ্যে অধিকাংশরাই এক নজর দেখে বাড়তি ঝামেলা মনে করে এড়িয়ে যান। আবার কারও মন কাঁদলেও আইনি ঝামেলার ভয়ে দূরে থাকেন।
তবে সবার থেকে এক ব্যতিক্রম নারী দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা ইউনিয়নের বাসিন্দা রাইহানা ইসলাম রুনা। তিনি জানান- গত ২৯ সেপ্টেম্বর আমার বাবা মারা গেছে। গত ৮ অক্টোবর সকালে আমি মহাসড়কের গোবিন্দপুর স্টেশনে নেমে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য অটোরিক্সায় উঠবো তখন দেখি এই বৃদ্ধ লোকটিকে ঘিরে রেখেন অনেক মানুষ। ওনাকে দেখার পর আমার বাবার কথা মনে পড়ে আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। ওই বৃদ্ধ লোকটির কথা বলার পর জানতে পারি ৫ অক্টোবর রাতে ওনার ছেলেরা নাকি হাসপাতাল থেকে বাড়ি নেয়ার কথা বলে হুইল চেয়ারে বসিয়ে এখানে ফেলে যান। এক সপ্তাহ যাবৎ বিভিন্ন স্থানে দৌঁড়াঝাপ করেও কোন কূল কিনারা করতে না পেরে অবশেষে সাংবাদিকদের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানাই।
শনিবার (১৪ অক্টোবর) বিকেলে মহাসড়কের গোবিন্দপুর স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় মহাসড়কের ঠিক পাশেই বসে আছেন এই বৃদ্ধ। হুইল চেয়ার থেকে পড়ে চোট পেয়েছেন কপালের পাশে ও পায়ে। মল-মূত্র ত্যাগ করে নিজেই ধুলোতে চাপা দিলেও দুর্গন্ধে একাকার। অসুস্থতার পাশাপাশি অনাহারে মুখ দিয়ে ঠিকমতো কথা আসছে না তার।
অস্পষ্ট কথায় তিনি বলেন- আমি দীর্ঘদিন অসুস্থ্য, আমাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রাতে গাড়ি থেকে নামিয়ে এখানে রেখে যায় আমার ছেলে হারুন সহ আরও ২জন। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ছয়ানী ইউনিয়নের ভবানী জীবনপুরের নয়নপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তিন ছেলে এক মেয়ের জনক তিনি। বড় ছেলে হারুন, মেঝ ছেলে মঈন, ছোট ছেলে জসিম উদ্দিন সবাই চাকুরী করে।
এদিকে স্থানীয় লোকজন জানান, রাতের অন্ধকারে এই বৃদ্ধকে ফেলে রাখে গেছে যারা তাদের প্রতি ধিক্কার জানাই। দেশে আইন আছে। এমন ঘটনায় আইনের কোন লোক এগিয়ে আসছে না। এই অসুস্থ লোকটি রাস্তার পাশে পড়েই থেকেই কি তার করুণ মৃত্যু ঘটবে?
শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার তাপস শীলকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি অবহিত করলে রাত ১০টায় তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনার গোবিন্দপুর স্টেশনে গিয়ে ওই বৃদ্ধের মুখ থেকে এবং স্থানীয়দের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনেন। এমন অমানিক ঘটনা দেখে ধুলো-বালি মাখা ওই বৃদ্ধের গায়ের দুর্গন্ধকে আপন করে মানবিকতার পরিচয় দিয়ে নিজের গাড়ি যোগে হাসপাতালে নিয়ে আসেন ইউএনও তাপস শীল। হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে অভিভাবকের স্থানে নাম লেখান ইউএনও নিজেই।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. আরিফুর রহমান জানান- ইউএনও স্যার রাতে ওই বৃদ্ধকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর থেকে আমাদের চিকিৎসা ও সেবা শশ্রƒষা চালিয়ে যাচ্ছি। ওই বৃদ্ধের বাম হাত ও বাম পা প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত। বেশ কয়েকদিন অযতœ অবহেলায় থাকায় এবং বাধ্যক্য জনিত কারণে কিছুটা মানসিক অস্থিরতা রয়েছে। আরও কোন সমস্যা আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করছি।
চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাপস শীল জানান, অমানবিক এমন ঘটনাটি আমি শুনার সাথে সাথেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছি। মহাসড়কের গোবিন্দপুর স্টেশনের আশরা রাস্তার মাথা থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। ঘটনাটি অত্যন্ত অমানবিক। তাঁর নাম ও ঠিকানা যাচাই-বাছাই করে পরিবারের লোকজনদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এছাড়া ঘটনাটি আগে জানলে আরও ভাল হতো। এভাবে লোকটি রাস্তায় পড়ে থাকতে হতো না।